সুলতানা শিরীন সাজি, কবি, অটোয়া:
আজকাল সকালবেলা ঘুম ভেঙে যায় পাখির কিচিরমিচির ডাকে।
প্রার্থনার বিশাল শক্তি আছে। মন থেকে চাইলে সব পাওয়া যায়। এই বিশ্বাস নিয়েই নিজের ভিতর নিজেই একটা পৃথিবী বানিয়েছি। যদি বলি ঘর। তাও বলা যায়।
যখন ঘর ছেড়ে বেরোই। পথ হাঁটি। নিজের ভিতর থেকে অদ্ভুত অনুরণন চলে। বেঁচে থাকার আনন্দের। খুব প্রয়োজন ছাড়া বের হচ্ছিনা আমরা অনেক মাস। আমার আশেপাশের মানুষ যখন তিনমাস হলো ঘরে ঢুকেছে। আমরা সাতমাস হলো সেই ঘরেতেই। শুধু বেঁচে থাকার জন্যই এই ঘরে থাকা।
একটা অদ্ভুত সময়ের মধ্যে দিয়ে আমরা যাচ্ছি। প্রতিদিন চারিদিকে মৃত্যুর কোলাহল। দূরত্ব বজায় রেখে মানুষের সাথে দেখা হওয়া। বাসার ভিতরে ঘুরে ফিরে আমরা সবাই সবার কাছে।
আজ সকালে বাসার পিছনে সিঁড়িতে বসেছিলাম। কতগুলো পাখি খেলা করছিল ঝাউ গাছে। গাছের উপরে থেকে নীচে ওরা লুটোপুটি করছিল। ওদের আনন্দের সাথে মিশে যাচ্ছিলাম। আমার পাখি মন উড়ে বেড়াচ্ছিল আকাশ থেকে আকাশে। স্মৃতির রেলগাড়িতে চড়ে মন কখন যেনো চলে গেলো দুই বছর আগের এক সকালে।
শান্তিনিকেতন এ বেড়ানোর চারদিনের শেষ দিনে সকালবেলা গিয়েছিলাম কোপাই নদী দেখতে। নদীরা সবখানেই একই রকম। নদী, মানুষ, পাখি আর গাছের কেমন যেনো মিল আছে।
শান্ত ছিমছাম সকাল। এপ্রিলের শুরুতেও সকাল কেমন যেনো কুয়াশামাখা। টোটো ছুটে চলেছে আর নিজের ভিতরে কেমন যেনো অদ্ভুত অপেক্ষা। কোপাই এর সাথে দেখা হবে। কোপাই নদী। বুদ্ধেদেব গুহ’র বই “অববাহিকা” পড়ে এই নদীর প্রতি আগ্রহ আরো বেড়ে গিয়েছিল। এটা ময়ূরাক্ষী নদীর একটা উপনদী। মানুষ আর নদী একই রকম। এক একটা মানুষ যেমন এক একজনের কাছে এক এক রকম ভাবে নিজেকে উপস্থাপন করে, নদীও তাই। এক এক জায়গায় গিয়ে ভিন্নভাবে বয়ে চলে।
কোপাই এর কাছে যাবার আগেই শুনছিলাম, শীতের শীর্ণ কোপাই এ এখন জল নেই। ব্রীজ না থাকলে কেউ বুঝতোনা এটা নদী। এইসব আরো কত কি! আমি শুনেও শুনছিলাম না।
আমরা তিনবোন, সাথে জিপসী। চারবোনের মতই তুমুল আনন্দে ঘুরেছিলাম ক’টাদিন। কোপাই নদীর ব্রীজের কাছে গিয়ে টোটোটা থেমে গেলো। জীর্ণ শীর্ন শীতের কোপাই নদী। নেমে গেলাম অনেকদূর। বর্ষায় ভরে যায় এই নদী। নদীকে বুঝতে হলে তার জল ছুঁতে হয়। শুকনো নদীর মাঝখানেই দাঁড়ালাম দিয়ে। ধীরে বয়ে চলছিল জলের ধারা।
আহা সময়! সময়ের সেই অনুভবগুলো আজো রিনরিন করে বয়ে গেলো আমার ভিতর। সুরের মতন, গানের মতন, প্রিয় কবিতার ঘোরের মতন!
ছবি খুঁজতে শুরু করলাম ঘরে এসে। অনেক ছবিতো ছিলো।কয়েকটা খুঁজে পেলাম। কোপাই এর কাছে যেতে পেরেছিলাম সেই আনন্দটা আবারো বুকের মধ্যে নদীর জলের স্রোতের মত বয়ে গেলো।
মানুষ আমরা আসলে কখনো নদী, কখনো পাখির মত!
কেনো বারবার শুধু এই কথায় মনের হয় আমার?
কোপাই এর ব্রীজের পাশে অনেকগুলো পাথরের স্তুপ ছিলো। ওখানে বসে থাকলাম আমরা। সকালের সুন্দর সেই পরিবেশকে নিজের মধ্যে ধারণ করে নিচ্ছিলাম। কে জানে আর যদি কোনদিন না আসা হয়! শান্তিনিকেতন এ আসতে পারা আমার কাছে ভীষন আনন্দের।
সেই বোলপুর স্টেশন।
কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ি।
ধূলোমাখা সোনাঝুরির পথ।
পূর্ব পল্লীর সেই সারি সারি গাছ।
দ্বারন্দার পার্থ’র থিয়েটার কটেজ
নীলাঞ্জনের বাড়ি কোকোরো।
আর কোপাই নদী!
আমার কানের ভিতর কবিতার গুঞ্জরণ চলে………… “হাওয়া বয় সন সন তারারা কাঁপে।” প্রেমেন্দ্র মিত্রের জং কবিতার লাইন।
নদীর কাছে গিয়ে এমন এলোমেলো হয়েছিলাম সেদিন। দূরের কোন এক ইটখোলা থেকে ধোঁয়া ভেসে আসছিল।
এমনিতে শান্তিনিকেতনে আসতে পারার আনন্দে ডুবে ছিলাম কয়েকদিন। মানুষের ইচ্ছে আর ইচ্ছেপূরণের গল্পে কত কিছুই তো থাকে। আমার স্বপ্ন ছিলো বোলপুর। কবি গুরুর শান্তিনিকেতন এ্র বিশ্বভারতীতে রবীন্দ্র সংগীত শিখতে যাবো এটা আমার বুকের ভিতরের এক লুকানো স্বপ্ন। কোনদিন কাউকে বলিনি। শুধু মনে হয়েছে যদি কোনদিন এই ইচ্ছেরা পাখি মেলে! মানুষের বেশিরভাগ ইচ্ছেই বুকের ভিতরে জমা থাকে। আর আমরা যে সময়ের মানুষ! তখন অনেক স্বপ্ন এবং ইচ্ছে শুধু বুনতে হতো চোখের ভিতর, মনের ভিতর। অন্যদেশে গিয়ে রবীন্দ্রসংগীত শেখার ইচ্ছেটা তখন মরীচিকা!
কোপাই এর কথা লিখতে বসে কত কথা লেখা হয়ে গেলো। কথা হলো নদীর স্রোতের মত। কখন যে উপছে আসে। শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেসের সেই অন্ধ বাউলের গানটা ব্যথার মত সুর হয়ে বাজে……… “মন চলো যাই ভ্রমনে, কৃষ্ণের অনুরাগের বাগানে”।
কোপাই থেকে গেস্ট হাউজে ফেরার পথে রাস্তার ধারে চায়ের দোকানে ভাড়ে চা খেয়েছিলাম। সেই ভাঁড়ের চায়ের জন্য আজ সকালটা মন কেমন করলো। মানুষের মন বড় অদ্ভুত!
কখন কিযে চায়!
………………………………….
পৃথিবীটা বড় এলোমেলো হয়ে গেছে।
এক অদৃশ্য অসুখের তোপে সারা পৃথিবীর মানুষ বিপর্যস্ত।
আমাদের প্রার্থনায় সুস্থভাবে, নিরাপদে বেঁচে থাকা। আমরা সবাই ঘরে আছি।
সবাই ঘোরেও আছি। বেঁচে থাকার ঘোর!
২ জুন, ২০২০
অটোয়া
★সুলতানা শিরীন সাজি-এর ফেসবুক থেকে।